ক্যান্সার নিরাময়ে আশা দেখাচ্ছে নতুন থেরাপি

ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন একটি থেরাপি (চিকিৎসাপদ্ধতি) বেশ আশা জাগিয়েছে। সেই থেরাপিতে শরীরের ক্ষতিকর কোষ ধ্বংস করে দেয়, এমন একটি সাধারণ ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা এ ক্ষেত্রে বড় সাফল্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তির ক্যানসার নিরাময় হয়েছে। অন্যদের টিউমারও ছোট হয়ে গেছে।

গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে ঠান্ডাজাতীয় ‘হারপেস সিমপ্লেক্স’ নামে ভাইরাসের একটি দুর্বল ধরন। টিউমারকে ধ্বংস করতে এটি রূপান্তর (মডিফায়েড) করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আরও বড় পরিসরের গবষেণা করা প্রয়োজন। যদিও বিশেষজ্ঞরা আশা প্রকাশ করছেন, এই চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে ক্যানসারে আক্রান্ত অনেক জটিল রোগীর জীবন রক্ষা করা যেতে পারে।

ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের ওপর এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগ এখনো পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এটি পরিচালনা করছে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মারসডেন এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ। ক্যান্সার রোগীর ওপর চলমান এই পরীক্ষার ফলাফল ফ্রান্সের প্যারিসে একটি মেডিকেল কনফারেন্সে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রথম ধাপের এই পরীক্ষায় ক্যান্সার আক্রান্ত যেসব রোগী অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন পশ্চিম লন্ডনের বাসিন্দা কিরজিস্তফ ওজকোয়াসকি (৩৯)। ২০১৭ সালে তাঁর মুখের কাছে লালাগ্রন্থিতে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। ওই সময় অস্ত্রোপচার ও অন্য অনেক চিকিৎসা নেন তিনি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁর ওই ক্ষত বাড়তে থাকে।

কিরজিস্তফ বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমার জন্য আর কোনো উপায় (ক্যান্সার নিরাময়ের) অবশিষ্ট নেই। এর পর থেকে আমি আর বেশি দিন বেঁচে নেই ধরে নিয়ে সেবা নিতে থাকি। তখন আমার জন্য সেই পরিস্থিতি ছিল বিপর্যয়কর। ফলে গবেষণা পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’

সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ওই থেরাপির একটি কোর্স নিয়ে কিরজিস্তফের ক্যান্সার নিরাময় হতে দেখা গেছে। তাঁকে হারপেস ভাইরাসের একটি রূপান্তরিত সংস্করণের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। কিরজিস্তফ বলেন, ‘পাঁচ সপ্তাহ ধরে দুই সপ্তাহ অন্তর আমি ইনজেকশন নিই। এরপর দুই বছর ধরে আমি ক্যান্সারমুক্ত।’

গবেষণার অংশ হিসেবে প্রায় ৪০ জন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। কিছু ব্যক্তিকে ভাইরাস ইনজেকশন দেওয়া হয়, যেটার পোশাকি নাম আরপি২। অন্যদের দেওয়া হয় ক্যান্সারের ওষুধ নিভোলুম্যাব। আরপি২ দেওয়া নয়জন রোগীর তিনজনের টিউমার ছোট হয়ে গেছে, যার মধ্যে কিরজিস্তফও রয়েছেন। একসঙ্গে দুটি চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা ৩০ জনের মধ্যে ৭ জন ভালো ফল পেয়েছেন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম।

থেরাপিতে ব্যবহৃত সাধারণ ভাইরাসটি ইনজেকশনের মাধ্যমে সরাসরি টিউমারে দেওয়া হয়। এরপর সেটি দুইভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তির কোষগুলোকে আক্রমণ করে। প্রথমত, ক্যান্সারের কোষগুলোতে আক্রমণ করে এবং সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা সক্রিয় করে।

‘আমার নেই বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, তেমনি আছে বলে অহংকারের কিছু নেই’ – ক্যান্সারজয়ী ফারজানা

‘কখনোই কেশবতী ছিলাম না, তবে মাথায় চুল বেশ ভালোই ছিল। প্রথম কেমোথেরাপি দেওয়ার পর থেকে চুল ঝরতে শুরু করে। মাথার সব চুল পড়ে যাওয়ার পর আয়নায় যাতে নিজেকে দেখতে না হয়, তাই আয়না ঢেকে রাখতাম। বাইরে এমনকি ঘরেও টুপি পরে থাকতাম। দুই বছর এক মাস বয়সী ছেলে টুপি পরলেই রাগ করত। এখন আবার মাথাভর্তি চুল গজিয়েছে। ভবিষ্যতে আমার শরীরে ক্যানসার আবার ফিরে আসবে কি না, তা জানি না। তবে এই মুহূর্তে আমি ক্যানসার থেকে মুক্ত।’

জাপান থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কথাগুলো বলছিলেন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা ফারজানা সুলতানা। তাঁর কণ্ঠে আপাতত স্বস্তির বার্তা। গত এক বছরে ফারজানার জীবনে ঘটে গেছে নানা কষ্টের ঘটনা। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছিলাম হাত-পা কালো হওয়া থেকে শুরু করে চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। মাথায় চুল নেই। পরচুলা পরতাম। জাপানে কেউ কারও দিকে তাকায় না। তবে বাংলাদেশে থাকলে এই বিষয়গুলো নিয়ে অস্বস্তির মাত্রাটা বাড়ত।’

জাপানের টোকিও মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটিতে মলিকুলার ইমিউনোলজি বিভাগের পিএইচডি গবেষক ফারজানা সুলতানা। ২০১৯ সালে জাপান যান তিনি। ২০২০ সালের অক্টোবর সেশনে জাপানের মেক্সট স্কলারশিপ পাওয়ার পর ফারজানার ব্যস্ততা বাড়ে। সব ভালোই চলছিল। তবে শুকনা কাশি, রাতে অনেক ঘাম হতে থাকল। করোনার সময় বলে কাশি দিলে ল্যাবের অন্যরা বেশ খানিকটা বিরক্তই হতে থাকলেন। তাই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হলো। গত বছরের ডিসেম্বরে চিকিৎসক জানালেন, ফারজানা মেডিসটিনাল ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফোমায় আক্রান্ত। তারপর শুরু হয় অন্য রকমের যুদ্ধ।

ক্যানসার ধরা পড়ার আগের, ক্যানসারের চিকিৎসা চলার সময় টাক মাথার এবং বর্তমানে ছোট চুলের তিনটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন ফারজানা সুলতানা

ক্যান্সার ধরা পড়ার আগের, ক্যান্সারের চিকিৎসা চলার সময় টাক মাথার এবং বর্তমানে ছোট চুলের তিনটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন ফারজানা সুলতানা ফারজানা বলেন, নিজে চিকিৎসক, গবেষণার বিষয়বস্তুও ক্যান্সার। আর পরিবারে ক্যান্সার শব্দটি খুব একটা অপরিচিতও নয়।নানা, নানি আর এক মামা ক্যান্সারে মারা গেছেন। এক খালা বাংলাদেশেই স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়ে গত আট বছর ধরে ভালো আছেন। তারপরও নিজের ক্যান্সার হয়েছে, এ কথাটি জানার পর তা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন ছিল। বিদেশবিভুঁইয়ে ছোট বাচ্চা নিয়ে সব সামাল দেওয়া ছিল কঠিন এক সংগ্রাম। তবে স্বামী এ কে এম নজরুল ইসলাম শুধু ফারজানাকে নয়, সামলেছেন ছেলে ফাইজান নুবাইদকেও।

ফারজানা বলেন, ‘হাসপাতালের খাবার খেতে পারতাম না। আমার স্বামী সারা দিন অনলাইনে অফিস করে, অসুস্থ বাচ্চাকে দেখাশোনা করে, রাতে আবার আমার জন্য রান্না করে খাবার হাসপাতালে নিয়ে আসত। বাসায় কাজের কোনো সহকারী নেই। রোগেশোকে বিধ্বস্ত আমি বহুবার আশা হারিয়েছি, বহুবার রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি, কিন্তু স্বামীকে কখনো এতটুকু বিরক্ত হতে দেখিনি। যে পরম মমতা সে আমার প্রতি দেখিয়েছে, তার জায়গায় আমি থাকলে কখনো তা দেখাতে পারতাম বলে মনে হয় না।’

গত সোমবার ফারজানা সুলতানা তাঁর ফেসবুকে ক্যান্সারের আগে, ক্যান্সারের চিকিৎসা নেওয়ার সময় টাক মাথার এবং বর্তমানে ছোট চুলের তিনটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘নিচের তিনটি ছবিই আমার নিজের। তিনটি ছবিই গত এক বছরের মধ্যে তোলা।’ কেন ছবি তিনটি দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমার নেই এটা নিয়ে যেমন হতাশ হওয়ার কিছু নেই, তেমনি আমার আছে এটা নিয়ে অহংকার করারও কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা চাইলে নিতেও সময় লাগে না আবার দিতেও সময় লাগে না।’

ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ফারজানা বলেন, ‘কেমোথেরাপি নেওয়ার সময়টাতে আমার বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশাস ডিজিজ হতো। আমার থেকে আমার ছেলেও অসুস্থ হতো। এমনও গেছে আমি হাসপাতালে আর ছেলে বাসায় নেতিয়ে পড়ে আছে। জাপানে ছোট বাচ্চাকে হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। দিনের পর দিন আমি আমার ছেলেকে দেখিনি।’

ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালে এমন চেহারা হয়েছিল ফারজানা সুলতানার

শুধু ক্যান্সারের কারণেই ফারজানা অসুস্থ মাকে দেখতে বাংলাদেশে আসতে পারেননি। মায়ের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২২ দিন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন। দুই দেশে মা ও মেয়ের চরম খারাপ অবস্থা। ফারজানার তখন রেডিওথেরাপি চলছিল। কেউ কাউকে দেখতে যেতে পারছেন না। ফারজানা বলেন, ‘মায়ের অসুস্থতার সময় ডানা ঝাপটিয়েছি শুধু, উড়াল দিতে পারিনি। তারপর মাত্র ৫১ বছর বয়সে মা মারা গেলেন।’

ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার শক্তিটা ফারজানা পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। বলেন, ‘আমি আমার মাকে দেখেছি শুধু মনের জোরে দুটো অচল কিডনি নিয়ে দিনের পর দিন লড়াই করছেন। অসুস্থ শরীরে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহার করা স্যালাইন ব্যাগ নিয়ে আম্মু উমরাহ করতে গেছেন। আম্মুর কাছ থেকেই শিখেছি, শরীরের মৃত্যুর আগেই যেন কোনোভাবে মনটাকে মেরে না ফেলি।’ বাংলাদেশে ফারজানার বাবা আর এক বোন আছেন।

ফারজানা বলেন, মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন যাতে চিন্তা না করেন, তাই প্রথম দিকে ক্যানসারের কথা গোপন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে ভিডিও কল দিলে ফারজানা টুপি পরে চাদর গায়ে দিয়ে কথা বলতেন। মায়ের মন হয়তো কিছু আন্দাজ করত। তাই শুধু জানতে চাইতেন, মাথায় টুপি কেন? তখন ঠান্ডা থাকায় কোনোভাবে প্রশ্নগুলোকে পাশ কাটাতে পারতেন।

ফারজানা বলেন, ‘ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। তারপরও ভেঙে যাইনি। এখনো আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি। পিএইচডি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছি, এখন আবার নিয়মিত ল্যাব, গবেষণা, সংসার সবই করছি। আমি এখনো সুন্দর–সুস্থ একটা জীবনের স্বপ্ন দেখি।’

ফারজানা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে জাপানে যান। নিজের ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্যান্সার ধরা পড়ার পর শুরু হয়েছিল বিশাল এক জার্নি। টিউমারটা ছিল আমার হার্ট আর লাংসের মাঝে, অনেকগুলো ভাইটাল আর্টারি আর অর্গান রয়েছে সেখানে। অপারেশন করাটা খুব জটিল ছিল। চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপি দিয়ে টিউমারটা অপসারণ করবেন। ছয়টি কেমোথেরাপি আর ২০টি রেডিওথেরাপি লেগেছিল। সব মিলে সময় লেগেছিল ছয় মাস। হেলথ ইনস্যুরেন্সসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও খরচ হয় বাংলাদেশি ছয় লাখ টাকা। আর ছয় মাসের এক একটা দিন আমার কাছে এক একটা বছরের মতো মনে হতো।’

বাংলাদেশে কখনো ক্যান্সারের চিকিৎসা করাননি, তাই চিকিৎসার মান নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না ফারজানা। তবে খালার উদাহরণ দিয়ে বলেন, খালা বাংলাদেশেই চিকিৎসা করিয়েছেন এবং আট বছর ধরে ভালো আছেন। ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হলো কত তাড়াতাড়ি ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হলো। শনাক্ত করতে যত সময় বেশি লাগবে ততই ভালো হওয়ার আশা কমতে থাকবে।

ফারজানা এ ক্ষেত্রে তাঁর ল্যাবের সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কেননা, তাঁদের বিরক্তি কমাতে এবং আশ্বস্ত করতেই তিনি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তারপরও প্রায় আড়াই মাস লেগে গিয়েছিল, আর তত দিনে ক্যান্সার দ্বিতীয় ধাপে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ফারজানা বলেন, ‘সুস্থতা যে কত বড় নিয়ামত, সেটা অসুস্থ না হলে আসলে বোঝা যায় না। তাই রোগকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কামরুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছরের আগে বলা যাবে না ফারজানা সুলতানা পুরোপুরি ক্যান্সারমুক্ত। আপাতত তাঁর শরীরে ক্যান্সারের অস্তিত্ব নেই বা পরীক্ষায় তা ধরা পড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার আবার ফিরে আসতে পারে। পাঁচ বছর তাঁকে ফলোআপে থাকতে হবে। তারপর রক্তের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় তাঁর শরীরে ক্যান্সারের অস্তিত্ব না পাওয়া গেলে তখন তাঁকে ক্যান্সারমুক্ত বলা যাবে।

কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত রঙিন ফুলকপি হাতে সন্তোষ বিশ্বাস (ডান থেকে দ্বিতীয়) ও তার স্ত্রী (সর্বডানে)।

সবজি চাষ: ক্যান্সার প্রতিরোধী কমলা আর বেগুনী রঙের ফুলকপির খোঁজে

নেত্রকোনার এক চাষি এবছর উজ্জ্বল হলুদ আর গাঢ় বেগুনী রঙের ফুলকপি চাষ করে রীতিমত তারকা বনে গেছেন।

শীত মৌসুমের জনপ্রিয় সবজি ফুলকপি সাদা রঙে দেখেই আমরা অভ্যস্ত। শহরের মানুষ বড়জোর কাছাকাছি জাতের সবুজ রঙের ব্রকলি চেনেন।জানা যাচ্ছে বর্ণিল এই ফুলকপিগুলোতে বেটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিন্সের পরিমাণ বেশি থাকায় এগুলোর রয়েছে ক্যান্সারসহ আরো নানা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা।

প্রান্তিক এই চাষি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তিনি বাইশ বছর ধরে কৃষিকাজ করেন। এটাই তার ও তার পরিবারের রুটিরুজি।কিন্তু এবার এই হলুদ আর বেগুনি ফুলকপি চাষ করার পরই প্রথম তাকে নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে।”এত ফোন পাচ্ছি, এত কৃষক আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, যে আমি রীতিমত অভিভূত”, বলছিলেন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরের গ্রাম রসুলপুরের কৃষক সন্তোষ বিশ্বাস।মি. বিশ্বাস এখন পরিকল্পনা করছেন, আসছে শীত মৌসুমে তিনি নিজের পুরো জমিতে রঙিন ফুলকপির চাষ করবেন।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এর বীজ বা চারা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।এমনকি গত শীতে, যখন ফুলকপি চাষের মৌসুম ইতিমধ্যেই শেষ, তখন যাদের কাছে এই চারা পেয়েছিলেন মি. বিশ্বাস, তারা নাকি জানতেনই না এটা ফুলকপির চারা।জামালপুরের যে নার্সারি থেকে চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন ওই নার্সারির লোকজনই “জানতো না এগুলো ফুলকপির চারা”, বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে কৃষি অধিদপ্তর আয়োজিত ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তাকরণ’ প্রকল্পের আওতায় নেত্রকোনার জনা ত্রিশেক কৃষকের সাথে জামালপুর, শেরপুর আর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন কৃষি খামার পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন সন্তোষ বিশ্বাস।জামালপুর সদরের এক খামারে চারাগুলোর সন্ধান পান তিনি।

রঙিন ফুলকপি

“ওরা বলছিল এগুলো ব্রকলির চারা। রঙটাও ঠিকঠাক বলতে পারেনি। বলছিল লাল আর গোলাপি হতে পারে।”শ তিনেক চারা ছিল ওদের কাছে। যদিও সিজন শেষ, কিন্তু আমি যেহেতু ব্রকলি আর ফুলকপি করি, তাই রঙিন দেখে বললাম, যতগুলো চারা আছে সবগুলো দিন।”

মৌসুম যদিও শেষ তারপরও বাড়িতে এনে কাঠা তিনেক জমিতে চারাগুলো পুঁতে দেন মি. বিশ্বাস। তারপর খুব করে যত্ন করেন। বেশি করে ভার্মিকম্পোস্ট সার দেন জমিতে।চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে তার ক্ষেতটি বর্ণিল হয়ে ওঠে। ভরে যায় উজ্জ্বল হলুদ আর গাঢ় বেগুনী রঙের ফুলকপিতে।বেগুনি ফুলকপিগুলোর এক একটির ওজন হয় দেড় কেজির ওপরে। আর হলুদগুলো হয় বারোশ থেকে চৌদ্দশ গ্রামের।

মি. বিশ্বাসের ক্ষেতে হওয়া উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের ফুলকপিটি মূলত কমলা বর্ণের হয়, জানা যাচ্ছে কৃষি বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও নিবন্ধ ঘেঁটে।

কোথায় মিলবে এই ফুলকপির চারা ও বীজ?

সন্তোষ বিশ্বাসের ৫ সদস্যের পরিবারের রুটি-রুজি কৃষিকাজ। এক একরের সামান্য কিছু বেশি জমি রয়েছে তার। এর কিছু অংশে তিনি ধান চাষ করেন সারা বছরের খোরাকীর জন্য। বাকি জমিতে সবজি চাষ করেন।”বছরভরই কোন না কোন সবজি আমি করি যাতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিক্রি করা যায়”, বলেন সন্তোষ বিশ্বাস।পড়তি মৌসুমে শ তিনেক রঙিন ফুলকপি চাষ করে এরই মধ্যে তারকা বনে গেছেন মি. বিশ্বাস।

কমলা ফুলকপি
অতিরিক্ত পরিমাণে বেটা ক্যারোটিন থাকার কারণে এটার এমন রঙ।

তার ক্ষেতে উৎপাদিত ফুলকপি প্রদর্শিত হয়েছে সরকারের আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলা আর কৃষি প্রদর্শনীগুলোতে।বিভিন্ন জায়গা থেকে সবজি চাষিরা তার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন – কোথায় পাওয়া যাবে এই ফুলকপির বীজ বা চারা? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, জামালপুরের যে খামারটি থেকে তিনি চারাগুলো এনেছিলেন, তখন তাড়াহুড়োয় তাদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি।এমনকি খামারটির নামও তার মনে নেই। শুধু জায়গাটা মনে আছে।

কোথায় পাওয়া যাবে এর বীজ বা চারা?

ঢাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছিলেন, তারাও খবর দিতে পারেনি তেমন। শুধু বলেছে, এই বীজ ভারতে পাওয়া যায়।এখন তিনি পরিকল্পনা করছেন সশরীরে জামালপুরের ওই খামারটিতে যাবেন, তথ্য সংগ্রহ করতে এবং সম্ভব হলে তাদের কাছ থেকে বীজ বা চারা সংগ্রহ করবেন।

জামালপুরের কৃষি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে খোঁজ পাওয়া গেল বাংলাদেশ অ্যাগ্রো কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের।জেলা সদরে এক একরের মত জমির উপর এই খামারটির বিশেষত্ব – তারা শুধু সবজির চারা উৎপাদন করে এবং সেটা তারা মাটিতে উৎপাদন করে না। তাদের চারা উৎপাদিত হয় কোকোফিডের মধ্যে। সন্তোষ বিশ্বাস সম্ভবত এই খামারটি থেকেই রঙিন ফুলকপির চারা এনেছিলেন। কারণ এই খামারটিই গত বছরের শেষের দিকে ভারত থেকে কিছু রঙিন ফুলকপির বীজ এনেছিল পরীক্ষামূলকভাবে। রবি মৌসুমে তারা সেখান থেকে হাজার দুয়েক চারা উৎপাদন করে এবং বেশ সাড়া পায়।

এ বছর রবি মৌসুম আসার বেশ আগেই খামারটি এরই মধ্যে কুড়ি হাজার চারার চাহিদা পেয়েছে, বিবিসিকে বলছিলেন বাংলাদেশ এগ্রো কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান।

রঙিন ফুলকপি
সাদা, সবুজ, কমলা ও বেগুনী – এই চার রঙের হয় ফুলকপি।

তিনি বলেন, তারা এখন ভারতের সাথে যোগাযোগ করছেন বীজের জন্য যাতে চাহিদা মোতাবেক চারা উৎপাদন করা যায়।

‘হাই ভ্যালু ক্রপ’

সন্তোষ বিশ্বাস এক একটি ফুলকপি বিক্রি করেছেন একশো টাকার উপরে।যেখানে কদিন আগে সাদা ফুলকপি এক একটি তিনি বেচেছিলেন ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকায়। এই সবজিটিকে একটি ‘হাই ভ্যালু ক্রপ’ বা উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এটিকে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করবেন। “আমার শহরেই যেহেতু সবজিটির চারা হচ্ছে, তাই আমরা আগামী মৌসুমি আমার জেলার কৃষকদের এটি চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করবো”, বলছিলেন জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা। “কৃষকদের জন্য এটা করতে সোজা হবে, কারণ তাদেরকে চারা সংগ্রহ করতে দূরের কোন শহরে যেতে হবে না”।

এসব ফসল ‘হাই ভ্যালু’ হওয়ায় “কৃষকরা যাতে একটু বেশি বাজারমূল্য পায়, সেজন্য এধরণের ফসলের কৃষকদের আমরা আমাদের প্রদর্শনীগুলোতে আনার চেষ্টা করি”, বিবিসিকে বলেন মিজ সুলতানা।

শুধু কি রঙেই পার্থক্য?

অনলাইনে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লেখকদের নিবন্ধ ঘেঁটে যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে স্বাদের দিক থেকে সাদা ফুলকপির থেকে খুব একটা আলাদা নয় রঙিন ফুলকপি। তবে সন্তোষ বিশ্বাসের খামারে হলুদ বর্ণের ফুলকপি হলেও, এসব নিবন্ধ পড়ে জানা যাচ্ছে এটির রঙ মূলত কমলা। অতিরিক্ত পরিমাণে বেটা ক্যারোটিন থাকার কারণে এটার এমন রঙ। একই কারণে গাজরের রঙও কমলা হয়। এই রঙের সবজিতে অন্য রঙের সবজির তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি ভিটামিন এ উপাদান থাকে। ফলে এগুলো বেশি পুষ্টিকর।

 

বেগুনি ফুলকপি
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসিয়ানিন্সের উপস্থিতির কারণে এটির রঙ এমন বেগুনি।

বেগুনি ফুলকপি রান্নার পর বিবর্ণ হলেও কমলা ফুলকপি বিবর্ণ হয় না। তবে বেগুনি ফুলকপি সবচাইতে স্বাস্থ্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসিয়ানিন্সের উপস্থিতির কারণে এটির রঙ এমন বেগুনি। অন্যান্য কিছু সবজি এবং পণ্যে এমন উপাদান পাওয়া যায় – যেমন বেগুনি রঙের বাঁধাকপি কিংবা রেড ওয়াইন। কমলা ফুলকপির মত বেগুনি ফুলকপিতেও সাদা ফুলকপির তুলনায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেক বেশি থাকে। বেগুনি ফুলকপি প্রদাহ উপশম, কার্ডিওভাসকুল্যার সমস্যা এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে উপকারী। রান্না করার পর এটির রঙ হালকা সবুজাভ হয়ে যায়। আরেকটি রঙের ফুলকপিও হয়, সেটির রঙ সবুজ। এটিতে ক্লোরোফিলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। পশ্চিমা দেশে এটি ব্রকলিফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত। কারণ ফুলকপি হলেও দেখতে অনেকটা ব্রকলির মত। কৃষি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, আমরা যে সাদা ফুলকপি চিনি, তার চাইতে কিছুটা কম সময় লাগে এই রঙিন ফুলকপি চাষ করতে।

গাজীপুরে ৯৯টি অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ

গাজীপুরে গত তিনদিনে মোট ৯৯টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হয়েছে। এর অনেকগুলোকেই বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে। সাধারণ জনগণ সরকারি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও অনেকের মধ্যেই প্রশাসনিক এই তৎপরতার পর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বন্ধ রাখার দেশের মধ্যে পড়ো খোলা রাখা হচ্ছে কোন কোন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আবার বাইরে তালা লাগিয়ে ভেতরে কাজ করার চিত্র পাওয়া গেছে। গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার মো: খায়রুজ্জামান জানান, স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা উপজেলা ও প্রশাসনের মোট ১৪টি টিম ৩ দিন অভিযান চালিয়ে গাজীপুর মহানগর ও বিভিন্ন উপজেলা এলাকার মোট ৯৯টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মাত্র তিন দিনে স্বল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে সবগুলি অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। তালিকায় আরও ৫৭ টি অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৭২ ঘণ্টার মধ্যে অনিবন্ধিত ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ

আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ বৃহস্পতিবার (২৬ মে) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন গ্রহণ করেছে, কিন্তু নবায়ন করেনি, তাদের নিবন্ধন নবায়নের জন্য একটি সময়সীমা দিতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন গ্রহণ না করলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে অপারেশন করার সময় অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া ও ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ডাক্তার ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। লাইসেন্সপ্রাপ্তির আগে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না।

শস্যকণায় ক্যান্সার উপাদান ও সবজিতে ব্যাকটেরিয়া

দেশে উৎপাদিত চাল, বাদাম আর ভুট্টার কিছু নমুনায় মিলেছে ক্যান্সারের জন্য দায়ী উপাদান। সম্প্রতি পাঁচটি আলাদা গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের এক কর্মশালায় এই তথ্য জানানো হয়। ডাচ সরকারের অর্থায়নে ‘অরেঞ্জ নলেজ’ প্রকল্পের অধীনে এসব গবেষণা করেছেন বাংলাদেশের গবেষকেরা।

দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা চাল, ভুট্টা ও বাদামের ৬০টি নমুনার মধ্যে ৯টিতেই লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী ক্ষতিকর উপাদান ‘অ্যাফ্লাটক্সিন’ এর উপস্থিতি মিলেছে। ভুট্টা আর বাদামেই এই বিষাক্ত উপাদানটির উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।

গবেষক অধ্যাপক তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তাদের গবেষণায় ২০২১ সালে আমদানি করা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ৯টি শস্য ও পণ্য নিয়ে কাজ করেছেন তারা। চাল, ভুট্টা, বাদাম ছাড়াও আটা, মসুর ডাল, মুগ ডাল ও সরিষা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুর ও নাটোরসহ মোট ৯টি জেলার পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে মোট ৬০ টি নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। যার মধ্যে ৯টি নমুনা অর্থাৎ ১৫ শতাংশ শস্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান মিলেছে।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষক অধ্যাপক তাজুল ইসলাম জানান, যে ৯টি নমুনায় অ্যফ্লাটক্সিন পাওয়া গেছে তার মধ্যে চারটিতেই নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়েও সেটি বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। যা শরীরে ক্যান্সার এবং কিডনি জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

এছাড়াও তাদের আলাদা গবেষণায় উঠে এসেছে শসা, টমেটোর মত সালাদ তৈরির সবজি এবং দুগ্ধজাত খাবারে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস নামের আরেকটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরা পড়েছে।

শসা, টমেটো ও গাজরের ৮৫ নমুনা এবং আইসক্রিম, দই ও পনিরের ৮৩ নমুনা নিয়ে গবেষণা চালান তারা। ময়মনসিংহ, ফুলবাড়িয়া এবং ঈশ্বরদী জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় এসব নমুনা।

গবেষণায় দেখা যায়, নমুনার ১৯ শতাংশ শসা, ১০ শতাংশ টমেটো এবং ৩ শতাংশ গাজরে এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। আর আইসক্রিমের ৭ শতাংশ এবং দইয়ের ৪ শতাংশ নমুনায় লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিসের উপস্থিতি রয়েছে।

খাদ্যপণ্যে এমন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কারণ হিসেবে মল-মূত্রের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন গবেষকেরা।

এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মত রোগ থেকে শুরু করে নারীদের বন্ধ্যত্ব পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান তারা।

এছাড়ারও আলাদা এক গবেষণায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে সংগ্রহ করা লইট্টা মাছের শুঁটকির নমুনার ৫.৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রেও এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এই গবেষণা করেছেন। গবেষক অধ্যাপক শাহেদ রেজা জানান, সংগ্রহ করা ৪৫টি নমুনার ৫.৩৫ শতাংশ নমুনায় লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস এবং ৬.২৬ শতাংশ নমুনায় ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

তিনি জানান, এসব শুঁটকি ভালো করে না ধুয়ে কিংবা উচ্চতাপে রান্না না করা হলে ডায়রিয়া, কলেরা তো বটেই এমনকি শরীরে অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের মত ঘটনা ঘটাতে পারে।

এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ পরিচালিত এক গবেষণায় বিভিন্ন খামার থেকে সংগ্রহ করা দুধের নমুনায় এমোক্সিলিন এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি মিলেছে।

মানিকগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জের খুচরা বিক্রেতা এবং সিরাজগঞ্জ ও পাবনার খামার থেকে সংগ্রহ করা ২০০ টি নমুনার মধ্যে ছয়টি নমুনায় এই এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

মূলত গাভীর বিভিন্ন প্রদাহের চিকিৎসায় এসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে দুধ এবং দুধজাত খাবারে প্রবেশ করছে। গবেষকরা বলছেন, এসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়ে খামারিদের সচেতনতার অভাবের কারণেই এমনটা হচ্ছে।

পঞ্চম গবেষণায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান খুঁজতে পরীক্ষা চালান গবেষকেরা। মংলার পশুর নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাদামাটি, পানি এবং ১০ প্রজাতির মাছের ওপর গবেষণা চালান তারা।

এর মধ্যে পানি ও মাটির কিছু নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, সিসা ও ক্রোমিয়ামের মত উপাদান মিলেছে। মাছের মধ্যেও এসব ভারী পদার্থের উপস্থিতি মিললেও তা নির্ধারিত ক্ষমতার চেয়ে কম তাই এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন না গবেষকেরা।

তবে কাদামাটি বা পানিতে থাকা এসব ভারী ধাতু যে কোন সময় মাছ কিংবা সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তারা।

দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই অসংক্রামক রোগে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, প্রতিবছর দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই অসংক্রামক রোগে মারা যান। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) বিকেলে এক সায়েন্টিফিক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তার মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা যায় বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগে। অসংক্রামক রোগে প্রতিদিন ১ হাজার ৯০০ মানুষ মারা যান। ভালো চিকিৎসা সেবা দিতে গেলে গবেষণা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে অসংক্রামক রোগ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, দূষণও মৃত্যুর বড় কারণ। এর কারণেই নন কমিউনিকেবল রোগগুলো বেড়ে যায়। লাইফস্টাইল ও খাদ্যভ্যাসও এর জন্য দায়ী। মোবাইল ও স্কিন বেশি দেখার কারণে মানসিক সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। পাশাপাশি আত্মহত্যাও এসব কারণে বাড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্য পলিসি কেবিনেটে পাস হয়েছে। যেদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো নয় সে দেশের কাঠামো সুন্দর হয়না।

বরিশালে হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল

বরিশালে দুরারোগ্য ক্যানসারের যথাযথ চিকিৎসা না থাকায় গরিব–দুস্থ রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যান। অনেক রোগী ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছেন। এ জন্য বরিশালে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। সেই দাবি পূরণে কাজ শুরু করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগ বলছে, এরই মধ্যে ১৭ তলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরেই এই হাসপাতাল নির্মাণ হবে। এ জন্য একটি পরিত্যক্ত ডোবা বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। মাটি পরীক্ষা করে পাইল বসানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এখন অপেক্ষা শুধু প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের। হাসপাতালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন চলতি মাসের মধ্যেই হতে পারে।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ক্যানসার ইউনিট রয়েছে। তবে সেখানে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জনবল। কেবল রেডিওথেরাপি–নির্ভর হয়ে আছে ক্যানসার ইউনিটটি। ফলে এ অঞ্চলের মানুষকে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় রাজধানী ঢাকায়। এতে ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি ভোগান্তিও পোহাতে হচ্ছে পদে পদে।

“More Read”